Friday, November 30, 2012

আমাদের আজমিরীগঞ্জ ২৪ডট কম
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই বুঝি সন্ধ্যা হয়! যে বাঘের ভয়ে দু'পা দূরের সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখতে যাননি অতিথি ক্যারিবিয়ানরা, যে বাঘের চোখ এড়াতে খুলনার হোটেল ছেড়ে দু'পা ফেলেননি ক্রিস গেইলরা; 'বাঘ আমার ভীষণ ভয় লাগে...' বলে সেই ড্যারেন স্যামি বাঘের অভয়ারণ্যে যাওয়া এড়াতে পারলেও, হিংস্র বাঘের থাবা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেননি। গতকাল খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামেই এগারো ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে ক্ষতবিক্ষত হতে হয় টি২০ বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। টেস্ট হারে ক্ষুধার্ত বাঘ ক্যারিবিয়ানদের দিয়ে ভূরিভোজ সারে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে গেইলদের ৭ উইকেটে হারানোর আক্রোশ নিয়ে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে যা রক্তচাপ বাড়ানো অসহ্য টেনশন ছাড়াই উপভোগ করেছে গোটা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজে শুধুই হতাশা আর শোকের খবর দেখতে দেখতে বিষিয়ে যাওয়া মনগুলো ফের হর্ষোৎফুল্ল হয়েছে বিশ্বক্রিকেটের অভয়ারণ্যে এগারো বাঘ গর্জে ওঠায়। মুশফিকদের এ জয়টি ছিল বেদনাবিদ্ধ আনন্দমাখা এক অনুভূতি। আর তাই ম্যাচটিতে জয় নিশ্চিত করেও আকাশে ব্যাট তুলে নাচেননি অধিনায়ক। ম্যাচ শেষে সিরিজের এই প্রথম ম্যাচটি মুশফিক উৎসর্গ করেন আশুলিয়ায় অগি্নকাণ্ডে নিহত সেই পোশাক শ্রমিকদের স্মৃতির উদ্দেশে, যারা দেখে যেতে পারেননি বিজয় মাসের আগেই সারাদেশে লাল-সবুজ পতাকা উঁচুতে তুলে ধরেছেন ক্রিকেটাররা। বিজয় মাসের আগমনীতে এমন একটি জয়ের পর তাই ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সুখবর বয়ে আনা দলের প্রত্যেক সদস্যকে।
অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। এদিন অনেকটা রীতিবিরোধী হয়েই চ্যালেঞ্জিং এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর যা হয়নি, সেটাই করা
হয় ম্যাচে আনামুল হক বিজয়, মমিনুল হক সৌরভ, আবুল হাসান রাজু আর সোহাগ গাজীকে অভিষেক করিয়ে। ম্যাচ শুরু হওয়ার পরই গাজী বুঝিয়ে দেন অভিষেক বলেই ঘাবড়াতে হয় না, নতুন বলেই লাজুক থাকতে হয় না। এদিন ২৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে শুধু বাংলাদেশের ওয়ানডে বোলার হিসেবে সেরা অভিষেকই হয়নি গাজীর, সে সঙ্গে বিশ্বক্রিকেটেও 'গেইল ঘাতক' হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছেন পটুয়াখালীর এই দুর্দান্ত ছেলে। নবাগত গাজীর সঙ্গে অভিজ্ঞ আবদুর রাজ্জাকও এদিন ক্যারিবিয়ানদের নামিদামি ব্যাটিং লাইনআপকে পাড়ার ব্যাটসম্যানদের মানে নামিয়ে এনেছিলেন। নিজের ত্রিশতম জন্মদিনে তিনি তুলে নিয়েছেন পোলার্ড, রাসেল আর রামপালকে। মূলত বাংলাদেশি স্পিনেই বেসামাল অতিথি টিম লেজ গুটিয়েছিল ১৯৯ রানে অল আউট হয়ে। যেন ভয়ঙ্কর ব্যাঘ্রের সামনে মিনমিনে মার্জার। ক্লাস থ্রির ছাত্রকে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ক্লাসে বসিয়ে দিলে যেমন হয়, গেইল-পোলার্ডদের ততটাই যেন লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছিল সোহাগ গাজী আর আবদুর রাজ্জাকের স্পিনে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ৫ উইকেটে ১০২, গ্যালারিতে ব্যানার উঠল তখনই_ 'বাঘ এসেছে নিজের বনে... রাজা শুধুই বাঘ।' টেস্ট সিরিজে যে সম্মান কেড়ে নিয়েছিলি, এবার ফিরিয়ে দিয়ে যা! পাঁচ ম্যাচ সিরিজের এখনও ঢের বাকি, তারপরও সকাল যদি বাকি দিনটার ইঙ্গিতবাহী হয় তাহলে বাঘের আঁচড়ে রক্তাক্ত ক্যারিবিয়ানদের সামনে কঠিন চড়াই অপেক্ষা করছে। আর মুশফিকের 'ওরে নবীন, ওরে আমার কচিকাঁচা' ব্রিগেডের সামনে চ্যালেঞ্জ প্রমাণ করার এই জয় 'ফ্লুক' নয়। আসলে ক্যারিবিয়ানরা সুন্দর বাণিজ্যিক টি২০ ক্রিকেটে, বাংলাদেশ সুন্দর ওয়ানডে ক্রিকেটে।
এর কারণ গত চারটি ওয়ানডে ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। এবং প্রতিপক্ষের নামগুলো হেলাফেলা করার মতো নয়। এশিয়া কাপে ভারত, শ্রীলংকার পর পাকিস্তানের কাছে ফাইনালে শুধু হেরেছিল মুশফিকরা। এর প্রায় সাড়ে আট মাস পর এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাল বাংলাদেশিরা। ক্যারিবিয়ানদের সঙ্গে শেষবার গত বছর চট্টগ্রামেও জিতেছিল মুশফিকরা। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই ৬১ রানে অল আউট করে দেওয়ার খবর নিশ্চয় ভুলে যায়নি ক্রিকেটপ্রেমীরা। গতকাল বাংলাদেশ ৪০.২ ওভারে ৩ উইকেটে ২০১ রান তুলে জয় নিশ্চিত করার পর এই হারের কথাটি বলেই কিয়েরন পোলার্ডের স্মৃতি উসকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। হারের ক্ষতটি তখনও হয়তো জ্বলজ্বল করছিল। তাই প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে দার্শনিক উত্তর দিয়েছিলেন পোলার্ড_ 'আমরা অতীত নিয়ে পড়ে থাকি না, সামনের ম্যাচ নিয়েই ভাবছি।'
বাঘের ক্ষুরধার আঁচড়টা যে যথেস্ট ব্যথা দিয়েছে ক্যারিবিয়ানদের, তা পোলার্ডের চোখ-মুখ দেখেই স্পষ্ট হয়েছিল। তারও আগে সকালে টস জেতার পরই অবশ্য ক্যারিবিয়ানদের ডাঙ্গায় তোলা জলের মাছের মতো মনে হয়েছিল। মাশরাফির শর্ট অব লেন্থের বলগুলো খেলতে গেইল এবং সিমন্সকে যথেষ্ট বিরক্ত মনে হয়েছিল। তৃতীয় ওভারটিই মেডেন পেয়েছিলেন মাশরাফি। তার অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে মাপা বলগুলোর বেশ কয়েকটি দেখেশুনে ছেড়ে দিয়েছিলেন গেইল। তবে মেজাজ হারিয়ে ডাউন দ্য উইকেটে এসে একটি ছক্কা হাঁকিয়ে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়েছিলেন গেইল। ওই ওভারেই ১৪ রান নেওয়ার পর প্রথম দশ ওভারে ৪৭ রান পুঁজি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। এরপরই মাশরাফির সোজা আসা বলটি চালাতে গিয়ে এলবিডবি্লউর ফাঁদে পড়েন সিমন্স। তবে দিনের সবচেয়ে বড় মাছটি শিকার করেছিলেন বোধ হয় অভিষিক্ত সোহাগ গাজী। টেস্টের মতো এখানেও গাজীকে তুলে মারতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দিয়ে বসেন ৩৫ রানে থাকা গেইল। তবে সেটা যেভাবে এক হাতে লাফ দিয়ে লুফে নেন তামিম, তার ভিডিও অনেক দিন শিক্ষানবিশ ক্রিকেটারদের কোচিংয়ে দেখাতে পারবেন কোনো শিক্ষক। গেইল চলে যাওয়ার এক ওভার বাদে ফের গাজীর শিকার, এবারে স্যামুয়েলস গাজীকে খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন স্লিপে। ৫০ রানে ৩ উইকেট পড়ার পরও পোলার্ড ছিলেন ঠাণ্ডা মাথায়। কিন্তু ৫০ রানের জুটি গড়ার পর তিনিও রাজ্জাকের বল পুল করতে গিয়ে মিডঅফে মাশরাফির হাতে বন্দি হন। রান নেওয়ার তাড়ায় থাকা ব্রাভো রানআউট হন ৩৫ রানে। অধিনায়ক স্যামিও রিয়াদের বলে লংঅনে ক্যাচ দিয়ে বসেন। রাসেল ফিরে যান রাজ্জাকের বলে বোল্ড হয়ে। ১৩৩ রানে ৮ উইকেট পড়ার পরই ক্যারিবিয়ান বেশ কিছু সমর্থক ক্রিকইনফোতে তাদের মতামত দেন এভাবে_ 'বাংলাদেশের সামনে আরও একটি লজ্জার মুখে ক্যারিবিয়ান দল।' শেষ পর্যন্ত নবম উইকেটে নারিন আর রামপলের ৫৭ রানের জুটি দুইশ'র কাছাকাছি নিয়ে যায় দলের স্কোর।
সাকিব ছাড়া ২০০ রানের টার্গেট নিয়েও পোড়খাওয়া বাংলাদেশি সমর্থকরা চিন্তায় ছিল। তবে তারা এটাও জানত যদি তামিমের শুরুটা তামিমের মতো হয় তাহলে কাজটি সহজ হয়ে যাবে। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই স্যামুয়েলসকে মিডঅফ দিয়ে বাউন্ডারিছাড়া করে বুঝিয়ে দেন তিনি আছেন তার মতোই। তা লক্ষ্য দুইশ' হোক কিম্বা তিনশ'। মিড উইকেট, পয়েন্ট, মিডঅফ, এক্সট্রা কভার_ সব দিক দিয়েই বাউন্ডারি ছুটে তামিমের। তার নতুন সঙ্গী আনামুল হক বিজয় অবশ্য কিছুটা জড়তায় ছিলেন। দেরিতে শুরু করলেও বিজয়ও বেশ কিছু বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন। তবে জায়গায় দাঁড়িয়ে বিজয়ের ব্যাট চালানো দেখে ধারাভাষ্যকারও কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেছেন। তামিম রোচকে ছক্কা হাঁকিয়েই তার পঞ্চাশ রান পূরণ করেন। এ নিয়ে টানা পাঁচ ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করলেন তিনি। এরকম টানা নয়টি হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড রয়েছে জাভেদ মিয়াঁদাদের। তামিমকে সেটা ছুঁতে হলে হাতে থাকা চারটি ম্যাচেই এমনটি করতে হবে। তবে তার আগে গতকালই তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ওয়ানডে রান সংগ্রহকারীর জায়গাটি দখল করে নেন। নারিনকে কাট করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেওয়ার আগে তিনি ৫১ বলে ৫৮ রান করে জয়ের ভিত গড়ে দিয়ে যান। এদিন তার মতো টপ অর্ডারের প্রত্যেকেই প্রায় দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট করেছেন। মারার বল বাউন্ডারিছাড়া করেছেন, ছাড়ার বলটি ছেড়ে দিয়েছেন। আর এভাবেই বিজয় ৪১, নাঈম অপরাজিত ৫০, নাসির ২৮ আর মুশফিক অপরাজিত ১৬ রান করে সত্যিকার অর্থেই বাঘের রূপ দিয়েছেন গোটা দলের মধ্যে। যা দেখতে হলে সুন্দরবনে বাঘের অভয়ারণ্যে যেতে হয় না, মাঠে এলেই শুনতে পাওয়া যায় তাদের গর্জন। দেখতে পাওয়া যায় তাদের ক্ষিপ্রতা।
আগামী রোববার খুলনা স্টেডিয়ামে আবার মুখোমুখি হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment